এএসি ব্লকের সাত-সতেরো

উন্নত দেশগুলোতে অনেক আগেই ইটের ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়িঘর নির্মাণে ইটের পরিবর্তে বাঁশ, কাঠ, বোর্ড, জিপসাম, বøকসহ বিভিন্ন ধরনের পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহৃত হচ্ছে। ভয়াবহ পরিবেশদূষণের কারণেই ইটের ব্যবহার বন্ধ করেছে উন্নত দেশগুলো। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে পোড়ানো ইটের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হবে। বর্তমানে ইটভাটা স্থাপনের প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধই করে দেওয়া হয়েছে। যেগুলো আছে, সেগুলোও এখন বিভিন্নভাবে বন্ধের প্রক্রিয়া চলছে। কারণ ইট পোড়াতে মাটির উপরিভাগ এমনভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে যে এখন মাটির উপরিভাগ বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকছে না। উন্নত বিশে^ স্থাপনা নির্মাণে বহুল ব্যবহৃত একটি উপকরণ এএসি বøক। এই নতুন ধাঁচের নির্মাণ উপকরণটির আদ্যোপান্ত তুলে ধরছেন স্থপতি রাজীব চৌধুরী

এএসি বøক কী?

এএসি বøক হলো ইটের নতুন এক বিকল্প, যা দিয়ে সহজেই অনেক কম খরচে যেকোনো স্থাপনার দেয়াল তৈরি করা যায়। উপকরণটির আবিষ্কার হয় ১৯২৪ সালে, একজন সুইডিশ স্থপতির হাত ধরে। অলটারনেটিভ কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়ালের আবিষ্কারের চেষ্টায় এই বøকের উদ্ভব হয়। এটি একই সঙ্গে আবহাওয়া ও পরিবেশের জন্য বন্ধুসম এবং দামেও সাশ্রয়ী। এসব কারণে ধীরে ধীরে এএসি বøকের ব্যবহার বাড়তে থাকে। সম্প্রতি এই বøক ইটের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। 

এএসি বøক মানে হলো অঁঃড়পষধাবফ অবৎধঃবফ ঈবসবহঃ ইষড়পশং, এই বøক তৈরিতে ব্যবহার হয় বালু, সিমেন্ট, অ্যালুমিনিয়াম পাউডার ও কিছু রাসায়নিক। এই রাসায়নিকগুলো একত্রে মেশানোর পর একটা ফোম তৈরি হয়। এই ফোম শক্ত করে বা শুকিয়ে তৈরি করা হয় এএসি বøক। এই এএসি বøকের ভেতরটার প্রায় ৭০% ফাঁপা। এর ভেতরে প্রচুর স্পেস থাকে, যাতে বাতাস দিয়ে এটি ফোলানো হয়। ফলে এটি একই সঙ্গে সূর্য প্রতিরোধী ও পানিনিরোধী হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। ভেতরটা পুরোপুরি ফাঁপাও নয় বলে এটি একই সঙ্গে শক্ত প্রতিরোধী দেয়াল হিসেবেও কাজ করে।

সাইজ

এএসি বøক তিনটি সাইজে পাওয়া যায়। 

৬০০ মিলি ী ২০০ মিলি ী ১০০ মিলি 

৬০০ মিলি ী ২০০ মিলি ী ১৫০ মিলি 

৬০০ মিলি ী ২০০ মিলি ী ২০০ মিলি

এর মানে হলো একটি এএসি বøক মানে প্রায় ৬টি ইট। এভাবে ইটের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে এএসি বøক ব্যবহারে বাড়ির দেয়ালের জয়েন্টের পরিমাণ কমে যায় এবং এর মাধ্যমে বাড়ি তৈরির খরচ এটি কমিয়ে আনে। সঙ্গে বাড়ির লোডও কমে যায় অনেকাংশে।  

সাধারণ ইট ও এএসি বøকের পার্থক্য 

ইট

এএসি বøক

রং লালচে বা বাদামি

রং সাদাটে অথবা গ্রে

সব ইটের সাইজ একরকম হয় না

সব এএসি বøক সমান মাপের হয়

প্লাস্টার থিকনেস অন্তত ২০ মিলিমিটার

প্লাস্টার থিকনেস ১০ মিলিমিটার করলেই হয়

১০ ফুট বাই ১০ ফুট দেয়ালে ইটের জয়েন্ট হবে ১৬৬২টি

১০ ফুট বাই ১০ ফুটের দেয়ালে জয়েন্ট হবে ১৬২টি

একবারে ৫ ফুট বা ৭ ফুটের বেশি দেয়াল তোলা যায় না। এ জন্য অনেক সময় চলে যায় দেয়াল তৈরিতে

একবারে ৩ ফুটের বেশি তোলা যায় না। মাঝখানে লিন্টেল দিতে হয়। কিন্তু এটি তৈরিতে অনেক কম সময় লাগে।

লেবার চার্জ অনেক বেশি লাগে

লেবার চার্জ কমে যায় এর আকারের জন্য

পানিতে ভিজিয়ে ব্যবহার করতে হয় বলে পানির খরচ অনেক বেশি  

পানির কোনো ব্যবহার নেই বলে পানির খরচ বেঁচে যায়।

ইটের ড্রাই ডেনসিটি ১৯০০ কেজি প্রতি ঘনফুটে  

এএসি বøকের ড্রাই ডেনসিটি প্রতি ঘনফুটে ৬৫০ কেজি

ইটের কমপ্রেসিভ স্ট্রেন্থ ৭.৫ নিউটন/মিলিমিটার স্কয়ার 

এএসি বøকের কমপ্রেসিভ স্ট্রেন্থ ৩.৫-৬ নিউটন/মিলিমিটার স্কয়ার

এটি লোড বিয়ারিং স্ট্রাকচার হিসেবে ব্যবহার হয়

এটি লোড বিয়ারিং স্ট্রাকচার হিসেবে ব্যবহারযোগ্য নয়।

ইটের থার্মাল কন্ডাক্টিভিটি বেশি। তাই এটি সহজেই গরম হয়ে যায় বা শীতকালে ঠান্ডা হয়ে যায়

এএসি বøকের থার্মাল কন্ডাক্টিভিটি কম, তাই এটি ঠান্ডা বা গরমে ঘরের ভেতরকার তাপমাত্রা বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেয়।

ইটের দেয়ালের আগুন প্রতিরোধ ক্ষমতা দুই ঘণ্টা।

এএসি বøকের আগুন প্রতিরোধ ক্ষমতা ইটের দ্বিগুণ, ১৬০০ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপ এটি সহ্য করতে পারে, যা প্রায় ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত আগুন থেকে নিরাপদ রাখতে পারে।

ইটের দেয়াল ৪০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ নিরোধ করতে পারে

এএসি বøক ৬০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ নিরোধ করতে পারে।

ইটের পানি শোষণক্ষমতা ১৫-২৫ শতাংশ

এএসি বøকের পানি শোষণক্ষমতা ১৫ শতাংশ

ব্যবহারে ইটের ওয়েস্টেজ ৫%

এএসি বøকের ওয়েস্টেজ ২% এরও কম

স্টিল সেভিংয়ে ইটের কোনো ভূমিকা নেই

সাধারণ ইটের চেয়ে অন্তত ১৫% স্ট্রাকচারাল স্টিল সেভ করে থাকে

বর্ষাকাল বাদে সব সময় ইট বাজারে কিনতে পাওয়া যায়

এটি সব সময় পাওয়া যায়

এটি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে কোনো ভূমিকা নেই

এটি ব্যবহারে ১৫% পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হয়। বিশেষ করে এসির ব্যবহার কমাতে এর জুড়ি মেলা ভার।

এএসি বøক ব্যবহারের যত সমস্যা 

এএসি বøক বর্ষাকালে ব্যবহার করলে এর ভেতরকার আর্দ্রতা বের হতে পারে না বলে দেয়ালে ক্র্যাক আসে। এ জন্য শুষ্ক মৌসুমে এএসি বøক ব্যবহার উত্তম।

নমনীয় বলে দেয়াল তৈরির কাজ বেশ যতেœর সঙ্গে করতে হয়। যেখানে ইটের দেয়াল তৈরিতে ইট যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করলেও তেমন কোনো সমস্যা হয় না, সেখানে এএসি বøক ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটু এদিক-সেদিক হলেই এটি ভেঙে যায়। 

এএসি বøকের দেয়ালে স্ক্রু করার সময় মোটা লম্বা স্ক্রু ব্যবহার আবশ্যক। বিশেষ করে ইন্টেরিয়র কাজের ক্ষেত্রে এএসি বøকের দেয়ালে কেবিনেট বা অন্য কিছু ঝোলানোর ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা জরুরি। লম্বা স্ক্রু না হলে এটি থেকে সহজেই স্ক্রু বের হয়ে আসার আশঙ্কা থাকে, যা যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে যেকোনো সময়। 

এএসি বøক ব্যবহারের কিছু নিয়ম

ভেজানো যাবে না 

এএসি বøক ব্যবহারের মূল শর্তই হলো এটা ভেজানো যাবে না। সাধারণত মিস্ত্রিরা ইট পানিতে ভিজিয়ে নেয় দেয়াল বানানোর আগে। কিন্তু একই কাজ এএসি বøকের ক্ষেত্রে করলে কিন্তু বিপত্তি ঘটবে। কারণ এএসি বøক যতই হালকা ম্যাটেরিয়াল বা বড় হোক, এটি কিন্তু পানি শোষণ করে এবং এটি পানি শুষে ২ থেকে ৩ মিলিমিটার বড় হয়ে যায়। আবার শুকিয়ে গেলে আগের আকৃতি ধারণ করে। ফলে এটি দিয়ে সাধারণত কাজ করতে গেলে এটি মোটেও ভেজানো চলবে না। যদি ভুল করে ভিজিয়েও ফেলা হয়, তাহলে ভালোমতো শুকিয়ে এরপর ব্যবহার করতে হবে। সাইটে ডাম্পিংয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই এএসি বøকের নিচে কাঠের আস্তরণ দিয়ে এরপর বøক রাখতে হবে। নইলে নিচে থাকা বøকগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

সাধারণ মর্টার দিয়ে ইনস্টল না করা

এএসি বøক অবশ্যই সাধারণ মর্টার দিয়ে ইনস্টল করা যাবে না। এএসি বøক সাধারণ বালু-সিমেন্টের মিশ্রণে তৈরি মর্টার দিয়ে ইনস্টল করা যাবে না। কারণ বালু-সিমেন্টের মর্টার অবশ্যই পানি দিয়ে কিউরিং করতে হয়। কিন্তু কিউরিংয়ের এই সময়ে এএসি বøক পানি শোষণ করে ভারী ও বড় হয়ে গিয়ে দেয়ালে ফাটল আসে। এএসি বøক দিয়ে দেয়াল তৈরির জন্য অবশ্যই কনমিক্স ব্যবহার করতে হবে। এতে খুব কম পরিমাণ কনমিক্স ব্যবহার করে অনেক লম্বা দেয়াল তৈরি করা সম্ভব। 

লোড বিয়ারিং হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না

এএসি বøক খুবই নমনীয়, কিন্তু শব্দ ও তাপ প্রতিরোধী ম্যাটেরিয়াল। কিন্তু এটি মোটেও ওজন প্রতিরোধী ম্যাটেরিয়াল নয়। এটি বেশি ওজনে সহজেই ভেঙে পড়ে। তাই এটিকে লোড বিয়ারিং ম্যাটেরিয়াল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। 

কম দূরত্বের কলামে ব্যবহার করা যাবে না 

কলামের দূরত্ব বেশি হলে এএসি বøক দেয়ালে ব্যবহার করা যাবে না। এএসি বøক ব্যবহার করার জন্য অবশ্যই কিছুদূর পরপর কলাম থাকতেই হবে। কোনো বাড়ির কলাম থেকে কলামের দূরত্ব ১২ ফুটের বেশি হলে এটিতে এএসি বøক ব্যবহার না করাই উত্তম। যদি করতেও হয় এর মধ্যে একটি নকল কলাম তুলতে হবে। 

অধিক উচ্চতার দেয়াল তৈরিতে অতিরিক্ত লিন্টেল তৈরি

সাধারণত আমরা ইটের দেয়াল তৈরিতে ১০ ফুট পর্যন্ত কোনো লিন্টেল ব্যবহার করি না। ১০ ফুটের অধিক উচ্চতা হলে তখন ৭ ফুট অথবা ৮ ফুটে লিন্টেল তৈরি করা হয় দরজার উচ্চতা বিচারে। কিন্তু এএসি বøক দিয়ে দেয়াল তৈরি করতে হলে প্রতি ৪ ফুট পরপর একটা করে লিন্টেল দিয়ে প্রতি ফ্লোর (১০ ফুট হাইট হলে) অন্তত দুইটি লিন্টেল ব্যবহার করতে হয়। এতে দেয়ালের স্থায়িত্ব বাড়ে। 

প্লাস্টার ম্যাটেরিয়াল হিসেবে মর্টার ব্যবহার করা যাবে না

সাধারণ ইটের দেয়ালের মতো প্লাস্টার ম্যাটেরিয়াল হিসেবে সিমেন্ট-বালুর মর্টার ব্যবহার এএসি বøকের দেয়ালে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ এই প্লাস্টারে ও কাজ শেষে বেশ কয়েক দিন এটাকে কিউরিং করতে হয়। কিউরিংয়ের সময় পানি দেওয়ার পর এএসি বøকে পানি ঢুকে দেয়ালে ফাটল চলে আসতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে প্লাস্টার ম্যাটেরিয়াল হিসেবে একেবারে জিপসাম পাউডার দিয়ে তৈরি পুটি ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে পরবর্তী সময়ে সহজেই এটাকে সিলার ম্যাটেরিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে এর ওপর রং করে দেওয়া যায়। 

প্লাস্টারের সময় তার জালির ব্যবহার

জিপসাম দিয়ে প্লাস্টার করার সময় প্রতিটি বøকের জয়েন্টে ওয়্যার ম্যাশ বা চিকেন ম্যাশ ব্যবহার করলে জয়েন্টের ফাটল আটকানো যায়।

একসময় মানুষ পাথর কেটে ঘর বানাত। দিন বদলাচ্ছে। এখন এসেছে এএসি বøক। সামনে হয়তো আরও উন্নত ম্যাটেরিয়াল আসবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশের আবাসনসংকট কাটাতে হবে। এ জন্য নতুন নতুন ম্যাটেরিয়ালগুলো ব্যবহারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তবেই উন্নত জাতি হিসেবে আমরা পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব। আর এ জন্য চাই নতুন ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের সদিচ্ছা ও ব্যবহারের সঠিক জ্ঞান। এই প্রচেষ্টা একদিন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে আধুনিক পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর কাতারে।

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬০ তম সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top