ইরানের ইসফাহানের মালভূমির বৃহত্তম নদী জায়ানদেরুদের ওপর নির্মিত একটি ঐতিহাসিক ব্রিজ খাজু। এটি একই সঙ্গে একটি সেতু এবং বাঁধ হিসেবে কাজ করে। এটি ইসফাহানের কামাল ইসমাইল স্ট্রিটের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। জায়ানদেরুদের উত্তর তীরের খাজু আবাসিক এলাকাকে জরথুস্ট্রিয়ান কোয়ার্টারের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে সেতুটি। আগে জনসভার প্রাথমিক স্থান হিসেবে খাজু ব্রিজকেই ব্যবহার করতেন নগরের বাসিন্দারা।
ব্রিজে বিদ্যমান শিলালিপি থেকে জানা গেছে, ১৬৫০ সালে ইরানের রাজা দ্বিতীয় আব্বাসের শাসনামলে এটি নির্মাণ করা হয়। রাজা দ্বিতীয় আব্বাস এই ব্রিজে অবকাশ যাপন করতেন। তৎকালীন রাজার ব্যবহৃত একটি আসনের ভগ্নাংশ এখনো সেতুতে বিদ্যমান। ১৮৭৩ সালে সেতুটি সংস্কার করা হয়।
খাজু ব্রিজ ১৩৩ মিটার দীর্ঘ এবং ১২ মিটার চওড়া। ব্রিজটিতে ২৩টি অর্ধবৃত্তাকার খিলান রয়েছে। এটি মূলত টাইলওয়ার্ক (ছোট ছোট টাইলসের টুকরো দিয়ে নির্মিত নকশা) এবং পেইন্টিং দিয়ে সাজানো। ব্রিজটির কয়েকটি স্থানে রয়েছে টি-হাউসের মতো বসার পরিসর। ব্রিজের পাসওয়ে ২১টি বড় ও ২৬টি ছোট ইনলেট ও আউটলেট চ্যানেলসহ ইট ও পাথর দিয়ে তৈরি। এটি ৭ দশমিক ৫ মিটার চওড়া। ব্রিজে ব্যবহৃত পাথরের টুকরোগুলো ২ মিটারের বেশি লম্বা। প্রতিটি চ্যানেল থেকে সিলিংয়ের উচ্চতা ২১ মিটার। খিলানপথের নিচে বেশ কয়েকটি ¯øুইসগেট রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে জায়ানদেরুদের জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
ওরিসুন্ড ব্রিজ, ডেনমার্ক-সুইডেন
ইউরোপের একটি বিস্ময়কর ব্রিজ ওরিসুন্ড ব্রিজ। স্থানীয়ভাবে ব্রিজটি দ্বৎবংঁহফংনৎড়হ নামে পরিচিত। এই ব্রিজটি সুইডেন ও ডেনমার্ককে যুক্ত করেছে। এতে রয়েছে রেল ও সড়ক সংযোগ। এ ছাড়া মধ্য ইউরোপে ইন্টারনেট সেবার জন্য ওরিসুন্ড ব্রিজের মাধ্যমেই বহন করা হয়েছে ইন্টারনেটের অপটিক্যাল ফাইবার কেব্্ল।
ব্রিজটির মোট দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার বা ৫ মাইল। এর মধ্যে ৪ কিলোমিটার (২ দশমিক ৫ মাইল) সুদীর্ঘ টানেল রয়েছে। এ ব্রিজে পর্যটক ও স্থানীয় মিলে দৈনিক ৬০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করে। এক বছরে ওপরের ডেকের ৪ লেনের সড়কে ৬ মিলিয়ন যানবাহন চলাচল করে এবং নিচের ডেকের দুটি ট্রেন লাইনের প্রতিটিতে বছরে ৮ মিলিয়ন যাত্রী চলাচল করে। গাড়ি ব্যবহার করে সেতু পার হতে প্রায় ১০ মিনিট সময় লাগে।
এই ব্রিজ নির্মাণের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ১৯১০ সালে সুইডিশ পার্লামেন্টে প্রথম একটি সেতু নির্মাণের প্রস্তাব ওঠে। দীর্ঘ সময় পর ১৯৩৬ সালে প্রকৌশলী সংস্থার একটি কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে তা ডেনমার্কের পার্লামেন্টে উত্থাপন করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে প্রস্তাবনা সাময়িক বাদ দেওয়া হলেও ১৯৫০ ও ষাটের দশকে ব্রিজ নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়। অবশেষে কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না হওয়ায় ১৯৭৮ সালে পরিকল্পনা বাতিল হয়। ১৯৮০-র দশকে আবারও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ফিরে এলে দুই দেশের সরকার ওরিসুন্ড প্রকল্প বাস্তবায়নে মতৈক্যে পৌঁছায় এবং ১৯৯১ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
১৯৯১ সালে ডেনমার্ক ও সুইডেন সরকার যৌথভাবে এই মেগা প্রকল্পটি নির্মাণের কাজ শুরু করে। আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০০ সালের ১ জুলাই ওরিসুন্ড ব্রিজটি সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
ল্যাংকাউই স্কাই ব্রিজ, মালয়েশিয়া
ল্যাংকাউই স্কাই ব্রিজ মালয়েশিয়ার একটি অত্যাধুনিক ব্রিজ। এটি ১২৫ মিটার বা ৪১০ ফুট ওপরে নির্মিত একটি ঝুলন্ত ব্রিজ। ২০০৫ সালে ব্রিজটির নির্মাণ সম্পন্ন হয়। ব্রিজটি অন্য সাধারণ ব্রিজ বা সেতুর মতো লম্বা কিংবা বৃত্তচাপের মতো নয়। এটি পাহাড়ের ওপর নির্মিত হওয়ায় তা পাহাড়ি পথের মতোই দেখতে বাঁকা।
মালয়েশিয়ার কেদাহ রাজ্যের ল্যাংকাউই দ্বীপপুঞ্জের প্রধান দ্বীপ পুলাউ ল্যাংকাউইতে গুনুং মাত সিনকাংয়ের শিখরে ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মূল পাটাতনের উচ্চতা ৬৬০ মিটার বা ২ হাজার ১৭০ ফুট। রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের জন্য ২০১২ সালের জুলাই মাসে ব্রিজটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ব্রিজটি কয়েকবার খোলার উদ্যোগ নেওয়া হলেও স্থগিত করা হয়েছিল। তবে এটি আংশিকভাবে ফেব্রæয়ারি ২০১৫ সালে পুনরায় চালু হয়।
ল্যাংকাউই স্কাই ব্রিজ ডিজাইন করেছেন স্থপতি পিটার উইস। এই ব্রিজের পাটাতন ১ দশমিক ৮ মিটার বা ৫ দশমিক ৯ ফুট চওড়া। এতে মোট ৫টি ২৫ মিটার বা ৮২ ফুট দৈর্ঘ্যরে সেকশন (বøক) রয়েছে। দুই পাশে রয়েছে স্টিলের রেলিং এবং প্রতিরোধী প্রাচীর, যা তারের জাল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ব্রিজের পাটাতনের বাঁকানো অংশ চার জোড়া ফ্রন্ট-স্টে তারের দ্বারা সাসপেন্ড করা হয়েছে। বিদ্যমান তোরণের উচ্চতা ২৬৭ ফুট। বাঁকানো সেতুর পাটাতনটি তার মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি পাইলনের (টাওয়ার) মাথায় যুক্ত তারের মাধ্যমে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৬০ মিটার বা ২ হাজার ১৭০ ফুট উচ্চতায় ঝুলে আছে। পাইলনটি ৬০৪ দশমিক ৫ মিটার বা ১ হাজার ৯৮৩ ফুট উচ্চতায় একটি কংক্রিটের প্যাডের ওপর স্থাপন করা হয়েছে।
বাঁকা ব্রিজটির পাটাতনের দুই প্রান্ত বিপরীত পাহাড়ের চূড়ায় দুটি ত্রিভুজাকার ভিউপয়েন্ট প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংযুক্ত। সেতুটি একসঙ্গে ২৫০ জন লোক বহন করতে সক্ষম।
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫০ তম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০২৩