ইমারত নির্মাণে ফ্লোর ফিনিশিং অন্যতম একটি কাজ। সিমেন্ট কংক্রিট (সি.সি.) কিংবা রিইনফোর্সড সিমেন্ট কংক্রিট (আর.সি.সি.) ঢালাইকৃত ফ্লোরের ওপর ফাইনাল ফিনিশিং দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যভাবে ব্যবহারের উপযোগী করার লক্ষ্যে যে কাজটি করা হয়, তাকেই ফ্লোর ফিনিশিং বলা হয়। এই কাজটি সাধারণত আর্থিক সামর্থ্য এবং ব্যক্তিগত রুচির ওপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশে বিভিন্নভাবে ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজ করা হয়, যার প্রতিটি কাজের স্বকীয়তা এবং গুণগত মান ভিন্নতর। যেমন-
প্যাটেন্ট স্টোন উইথ নিট সিমেন্ট ফিনিশিং
কাস্ট-ইন-সিটু মোজাইক ফিনিশিং
মোজাইক টাইলস ফিনিশিং
সিরামিক টাইলস ফিনিশিং
মার্বেল ফিনিশিং
গ্রানাইট ফিনিশিং ইত্যাদি
এসব ফ্লোর ফিনিশিং আইটেমের মধ্যে যেটিই করা হোক না কেন, সেই কাজটি সম্পন্ন করতে ব্যবহৃত মালামাল এবং কাজের গুণগত মান রক্ষা করা অপরিহার্য একটি বিষয়। কারণ, যেকোনো কাজের ফিনিশিং রুচিসম্মত এবং স্থায়িত্বতা নিশ্চিত করা না গেলে সারা জীবন তার ফল ভোগ করতে হয়। ফলে ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজ সম্পূর্ণ করার আগে ঢালাইকৃত ফ্লোরে জমে থাকা মসলা (সিমেন্ট মর্টার) কিংবা আলগা ময়লা-মাটি পরিষ্কার করে ফ্লোর চিপিং করে ভালোমতো পরিষ্কার করা এবং পানি দিয়ে ওয়াশ করে নেওয়া জরুরি।
প্যাটেন্ট স্টোন উইথ নিট সিমেন্ট ফিনিশিং
সিমেন্ট কংক্রিট (সি.সি.) কিংবা রিইনফোর্সড সিমেন্ট কংক্রিট (আর.সি.সি.) ফ্লোরের ওপর ১ : ২ : ৪ অনুপাতে সিমেন্ট, বালি ও ইটের খোঁয়া/স্টোন চিপস একত্রে মিশিয়ে গড়ে ১.৫ ইঞ্চি পুরুত্বে ঢালাই করে উপরিভাগে নিট সিমেন্ট ফিনিশিং দিয়ে তৈরি ফ্লোরকে প্যাটেন্ট স্টোন ফ্লোর বলা হয়। প্যাটেন্ট স্টোন ফ্লোর ঢালাইয়ের পুরুত্ব কম বিধায় খোঁয়ার সাইজ ছোট হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্যাটেন্ট স্টোন ফ্লোর ঢালাইয়ের কাজে ইটের খোঁয়া কিংবা স্টোন চিপস যা-ই ব্যবহার করা হোক না কেন, তার সাইজ সাধারণত ১/২ ইঞ্চি ডাউন গ্রেডেড হয়ে থাকে।
প্যাটেন্ট স্টোন ঢালাইয়ের কাজে অন্যান্য কাজের মতোই খোঁয়া, বালি, সিমেন্ট, পানিÑ সবই দুষণমুক্ত হওয়া এবং ঢালাইকাজের পদ্ধতি যথাযথ হওয়া জরুরি। অত্র ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজে বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয়, ঢালাইয়ের কাজ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে নিট সিমেন্ট ফিনিশিংয়ের কাজটিও শেষ করা দরকার। নইলে ফিনিশিং দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে ভালোমতো ফিনিশিং দিতে না পারায় নতুন করে সিমেন্টের গোলা তৈরি করে ফিনিশিং দেওয়া হয়। যাতে কাজের গুণগত মান নষ্ট করে এবং পরবর্তীকালে ফিনিশিং নষ্ট হয়ে যায়।
তাই একই সঙ্গে সব এলাকা ঢালাই না করে একেকটা রুম আলাদা আলাদাভাবে ঢেলে ফিনিশিং দেওয়া দরকার। প্রয়োজনে একেক রুমে আলাদা আলাদা মিস্ত্রি ও হেলপার দিয়ে একই সময়ে সব কাজ করা সম্ভব। মোট কথা লোকবলের কথা বিবেচনায় নিয়ে কাজের পরিধি বাড়াতে হবে। প্যাটেন্ট স্টোন ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজ নিয়মমাফিক সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত লোক চলাচল বন্ধ রাখতে হবে। ফিনিশিং দেওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর রুমে পানি আটকিয়ে কমপক্ষে ৭ দিন পর্যন্ত কিউরিং করতে হবে। সম্ভব হলে ১৫ দিন পর্যন্ত কিউরিং করা যেতে পারে।
কাস্ট-ইন-সিটু মোজাইক ফিনিশিং
কাস্ট-ইন-সিটু মোজাইক ফিনিশিংয়ের কাজ তুলনামূলকভাবে শ্রমসাধ্য এবং ব্যয়বহুল। এই কাজটি ১ : ১ অনুপাতে মার্বেল চিপস ও সিমেন্টের মিশ্রণে ঢালাই করে পর্যায়ক্রমিকভাবে নানা ধরনের ফিনিশিং দেওয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। মোজাইক ঢালাইয়ের কাজে হোয়াইট এবং গ্রে দুই ধরনের সিমেন্টই ব্যবহার করা যায়। সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন কাজের জন্য ১০০% হোয়াইট সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়। এই কাজের খরচ সাশ্রয়কল্পে হোয়াইট সিমেন্টের সঙ্গে বিভিন্ন অনুপাতে গ্রে-সিমেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে দৃষ্টিনান্দনিকতা ছাড়া কাজের গুণগত মানের কোনো তারতম্য হয় না।
এ ছাড়া মার্বেল চিপসের বিভিন্ন কোয়ালিটি আছে, যা ব্যবহারকারীর আর্থিক সংগতি ও রুচির ওপর নির্ভর করে ব্যবহৃত হয়। মোজাইক ঢালাইয়ের পুরুত্ব খুবই কম (৩/৮ থেকে ১/২ ইঞ্চি), তাই মোজাইক ঢালাই করতে সম্পূর্ণ এলাকাটিকে ছোট ছোট প্যানেলে ভাগ করে নিতে হয়। নইলে সারফেসে ফাটল দেখা দেয় এবং স্থায়িত্ব কমে যায়। এই প্যানেল তৈরির জন্য সাধারণত গøাসের স্ট্রিপ ব্যবহার করা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্রাশের স্ট্রিপও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ব্যবহৃতব্য মালামাল এবং কাজের গুণগত মান ভালো হওয়া জরুরি, যার ওপর নির্ভরশীল কাজের স্থায়িত্ব।
কাস্ট-ইন-সিটু মোজাইক ফিনিশিংয়ের কাজটি বিভিন্ন ধাপে সম্পন্ন করা হয় এবং প্রতিটি ধাপেই সুষ্ঠু তদারকি দরকার। পর্যায়ক্রমিকভাবে কাজের ধাপগুলো নি¤েœ উল্লেখ করা হলো। যেমন-
পূর্বের ঢালাইকৃত আর.সি.সি ফ্লোর ভালোমতো চিপিং করা
আলগা ধুলাবালি সঠিভাবে পরিষ্কার করা
পানি দিয়ে ফ্লোর ওয়াশ করে নেওয়া
ফিনিশিং লেভেল নির্ধারণ করে নকশা মোতাবেক গাস স্ট্রিপ বসানো
মোজাইক ঢালাইয়ের জায়গা খালি রেখে প্যাটেন্ট স্টোন ঢালাই করা
মোজাইক ঢালাই করার আগে ভালোভাবে কিউরিং করা
নির্ধারিত অনুপাত ও ডিজাইন অনুযায়ী মোজাইক ঢালাই করা
মোজাইক ঢালাই শেষ করার ১০ ঘণ্টা পর পুনরায় পানি আটকিয়ে কিউরিং করা
পর্যাপ্ত (ন্যূনতম ৩০ দিন) কিউরিং করার পর মেশিন দিয়ে টপ সারফেস কেটে লেভেল করা
মেশিনে কাটার পর পাথর ও সিরিশ কাগজ ব্যবহারে হাতে কেটে ফিনিশিং দেওয়া এবং
সর্বশেষে অক্সালিক অ্যাসিড ও মোম দ্বারা পলিশ করার মাধ্যমে ফিনিশিং দেওয়া
মোজাইক ফ্লোর ফিনিশিংয়ের প্রতিটি কাজ সুদক্ষ কারিগর এবং সুষ্ঠু তদারকির মাধ্যমে সম্পাদন করা জরুরি। উপরোল্লিখিত কাজগুলোতে ব্যবহৃতব্য সব মালামাল যেমন- মার্বেল চিপস, সিমেন্ট, মোজাইক কাটার পাথর, সিরিশ কাগজ, অ্যাসিড, মোমÑ সবকিছুরই গুণগত মান এবং দামের তারতম্য অনেক। ফলে ব্যবহারকারীকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন কোয়ালিটির মালামাল ব্যবহার করবে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, মোজাইক ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজে ব্যবহৃতব্য প্রতিটি মালামালের গুণগত মানের ওপর কাজের মান ও স্থায়িত্ব নির্ভর করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কাজের জটিলতা এবং ব্যয়বহুলতা বিবেচনায় ইদানীং মোজাইকের ব্যবহার বিলুপ্ত প্রায়। তবে মোজাইক ফিনিশিংয়ের নান্দনিকতা এবং স্থায়িত্ব অনেক বেশি। প্রয়োজনে পুরোনো মোজাইকের ওপর পুনরায় মেশিন চালিয়ে নতুন রূপ দেওয়া যায়। তাই, ভবিষ্যতে মোজাইক ফ্লোরিং কাজের পুনঃপ্রচলন শুরু হতে পারে। পরবর্তী ধাপে মোজাইক ঢালাই করা এবং ফিনিশিং দেওয়ার পর্যায়ক্রমিক কাজগুলো নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে।
প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ
(চলবে)
লেখক
চিফ ইঞ্জিনিয়ার (অপারেশন)
এনা প্রপার্টিজ লি.
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৯ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০২৩