আর্থ হাউস যেন কল্পজগতে বসবাস

লর্ড অব দ্য রিংস মুভিটি হয়তো অনেকেই দেখেছেন! হবিট নামক এক ধরণের কাল্পনিক চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই মুভিতে। চিত্রায়িত হয়েছে মাটির নিচে তৈরীকৃত তাদের থাকার ঘরগুলো। হবিটরা যে শায়ারে বা স্বতন্ত্র আবাসস্থলে বাস করে তা হবিট হোল নামে পরিচিত। এ ধরণের বাড়ির অস্তিস্থ কি শুধু কল্পিত অ্যাডভেঞ্চার মুভিতেই মেলে; বাস্তবে যদি দেখা যেতো এমন ঘরগুলো! এমন প্রশ্ন হয়তো অনেকের। আর এই অনুসন্ধিৎসুদের জ্ঞাতার্থেই জানানো যাচ্ছে, সত্যিই রয়েছে এমন বসত। যদিও হবিটরা কাল্পনিক প্রাণী, তাদের ঘরবাড়িগুলোকে কিছুটা রূপকথার মতো কিন্তু বিশে^র বেশ কিছু দেশে মানুষ বহু বছর ধরে একই ধরনের আবাসস্থলে বসবাস করছে। তারমধ্যে অন্যতম সুইজারল্যান্ড। দেশটিতে হবিট হোল আবাসনকে বলা হয় আর্থ হাউস। ভিন্নধর্মী এই স্থাপনার কথাই জানাচ্ছেন গোলাম মোর্শেদ।     

দূর থেকে দেখলে মনে হবে ঘাসে ঢাকা ছোট ছোট টিলা বা পাহাড়। কিন্তু কাছে গেলে বিষ্ময়ের ঢেউ খেলে যাবে। পাহাড়ের ঢালে রীতিমত বাড়িঘর। হবিট হোলের মত গর্ত করে যেন ঢুকে গেছে পাহাড়ের গভীরে। অনেকটা দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় নির্মিত বাঙ্কার হাউসের মতো। সাধারণ বাড়ির সকল বৈশিষ্ট্যই মিলবে এ ধরণের আর্থ হাউসে।  প্রতিটি ঘরই ইগলু ঘরের মতো গোলাকার। ঘরগুলোর অধিকাংশই আবার দ্বিতল। নিচতলা থাকে রান্নাঘর, বসার ঘর, বাথরুম, টয়লেট আর ওপরতলায় রাখা হয় শোবার ঘর। প্রতিটি ঘর গোলাকার হওয়ায় তা একত্রিত করলে ইগলুর মতোই দেখায়। প্রতিটি ঘরেই রয়েছে জানালা, দরজা ও ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা। 

আর্থ হাউসগুলো প্রাকৃতিকভাবে নির্মিত এক অনন্য স্থাপত্য বিস্ময়। এটি বিশ্বের সবচেয়ে অপ্রচলিত আবাসনের মধ্যে একটি। আর্থ হাউস নির্মিত হয় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায় ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করে। কাঠ, বাঁশ, পাথরই এর মূল নির্মাণ উপকরণ। তবে আধুনিক বাড়িগুলোতে স্টিল, সিমেন্ট, কাচ, পিভিসি পাইপ ব্যবহার করা হয়। ঘরগুলোর জলরোধী ও স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করতে কাঠামোতে ব্যবহৃত হয় কংক্রিট স্প্রে। ছাদে রাখা হয় মাটির আস্তরণ। সেখানে লাগানো হয় ঘাস, লতাপাতা ও ফুলগাছ।

আর্থ হাউসগুলো মূলত একটি ক্লাস্টারে অনেকটাই ট আকৃতিতে নির্মিত হয়। বাড়িগুলোর মাঝে থাকে একটি কৃত্রিম পুকুর বা জলাধার। জলাধারের চারপাশে বসতবাড়িগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে অনেকটাই লাগোয়া। প্রবেশপথ একটাই যা কিছুটা লুকানো। দূর থেকে কেউ ভাবতেই পারবে না এখানে কোন ঘর-বাড়ি আছে! ঐতিহ্যগত এই ঘরগুলো ট আকৃতির হয় যেন প্রতিবেশিরা একে অন্যের কাছাকাছি থাকতে পারে। প্রতিটি আবাসন ক্লাস্টারের একপাশে থাকে বিস্তীর্ণ কৃষি জমি। বাসিন্দারা এই ভ‚মিতে চাষাবাদ করে থাকে। অদূরে আবার ছোট্ট ফলের বাগানও গড়ে তোলে অনেকেই।

বাইরে থেকে কোন দর্শনার্থী এসে ভাবতেই পারে মাটির নিচে ঘরগুলো নিশ্চয় খুব অন্ধকার হবে! কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করলে পাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা। ঘরগুলো মোটেও অন্ধকার নয় বরং প্রতিটি ঘরই বেশ আলোকময়। দেয়ালে স্থাপতি জানালা থেকে পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ করে। শুধু দেয়ালেই নয়, প্রতিটি কক্ষে আলো প্রবেশের ব্যবস্থা রাখা হয় ছাদ থেকে ছোট ছোট কাচ জানালার মাধ্যমে। তাই দিনের বেলায় পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলো পায় ঘরগুলো। 

প্রায়ই সুইজারল্যান্ডে গ্রীষ্মে অত্যন্ত খুব গরম অনুভ‚ত হয়। অনেক বাড়িতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকায় গরমে যেন কষ্টের শেষ থাকে না। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আর্থ হাউস। মূলত মাটিতে আবৃত বাড়িগুলোতে এসির কোন প্রয়োজনই পড়ে না। প্রচন্ড গরমেও যতেষ্ট ঠান্ডা থাকে ঘরগুলো। এছাড়াও মাঝখানের পুকুরটি তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে দারুণ সহায়ক। আবার শীতকালেও উষ্ণ থাকে। প্রচন্ড শীতে যখন বাকিসব ঘরগুলোর চমনি থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়, তখন এই অর্থ হাউসে গরম থাকতে কোন আগুন জ¦ালানোর কোন প্রয়োজন পড়ে না। কারণ ঘরগুলো প্রাকৃতিকভাবেই স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় থাকে।

পরিবেশ সুরক্ষা ও বিদ্যুৎ খরচ রোধে অর্থ হাউস অত্যন্ত কার্যকর। সুইজারল্যান্ডের অধিকাংশ বাড়ির তুলনায় বিদ্যুৎ খরচ সম্ভবত অর্ধেক, বা তারও কম। অন্যান্য বাড়ির তুলনায় নির্মাণব্যয়ও অনেক কম। বৈশি^ক উষ্ণতারোধে এ ধরণের বাড়ি এক কথায় অতুলনীয়। এখন যেহেতু তাপমাত্রা পরিবর্তিত হচ্ছে, বাড়ছে জীবনযাত্রায় ব্যয়, তাই অনেক স্থানীয় বাসিন্দা ভবিষ্যতের আবাসন হিসাবে এই আর্থ হাইসের কথায় ভাবছেন। 

সুইজারল্যান্ডের ডায়েটিকনে স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ঠবঃংপয অৎপযরঃবশঃঁৎ ‘আর্থ হাউস এস্টেট ল্যাটেনস্ট্রাস’ নামে কিছু অর্থ হাউস নির্মাণ করেছে বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে। এই প্রকল্পে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন আয়তনে নির্মিত হয়েছে আর্থ হাউস। আর্থ হাউসগুলি যে জমিতে তৈরি করা হয়েছে তা ৪,০০০ স্কয়ার মিটার জুড়ে। প্রতিটি পৃথক আবাসন ৬৪৬-২,১৫৩ স্কয়ার ফিটের মধ্যে। প্রতিটি আবাসনে রয়েছে তিন থেকে নয়টি কক্ষ। রাখা হচ্ছে রান্নাঘর, বাথরুম এমনকি সংযোগকারী সিঁড়ি। সুইজারল্যান্ডের ডায়েটিকন ছাড়াও জুরিখসহ সারা দেশে আরও অন্তত ডজন খানেক অনুরূপ বাড়ি তৈরি করেছে এ স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানটি।

অর্থ হাউসের নানা রকম পরিবেশগত সুবিধা ও নান্দনিকতা থাকলেও সমস্যা যে একেবারেই নেই তা কিন্তু নয়। এই আবাসনগুলো গোলাকার ইগলু আকৃতির হওয়ায় প্রচলিত আসবাবপত্র নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে। এজন্য ঘরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আসবাপত্র তৈরী করাই শ্রেয়। আরো একটি বিড়ম্বনা হতে পারে যারা দেয়ালে ছবি ঝুলিয়ে রাখতে চান তাদের জন্য! গোলাকার দেয়ালের কারণে সেটাও ভাবতে হবে ভিন্নভাবেই। এ ধরণের কিছু সামান্য প্রতিবন্ধকতা দূর করা গেলে অর্থ হাউসে বসবাস নিশ্চয় মন্দ হবে না!

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫১ তম সংখ্যা, মার্চ ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top