আর্কিটেকচার ডাইজেস্ট ম্যাগাজিন, স্থাপত্যবিদ্যার জনপ্রিয় একটি জনসংযোগের মাধ্যম। মূলত অডিও-ভিজ্যুয়ালে তারা ভীষণ জনপ্রিয়। বিশেষ করে চলচ্চিত্রজগতের তারকাদের বাড়িঘর দেখানোর মধ্য দিয়ে তারা অনেক মানুষের নজর কেড়েছে। এই জগতের সুপারহিট তারকারা নিজেদের ভাবমূর্তি ধরে রাখার জন্য রাজকীয় জীবনযাপন করে থাকেন। প্রত্যেকেরই একাধিক বাড়ি থাকায় কিছু বাড়িতে তারা নানারকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। সে রকমই একটা বাড়ির গল্প এটি। আয়রনম্যান, মারভেলজগতের জনপ্রিয় একটি চরিত্র। আর রুপালি পর্দায় আয়রনম্যানের চরিত্রে অভিনয় করে বিখ্যাত হয়েছেন রবার্ট ডাউনি জুনিয়র। তাঁর রয়েছে তিন-তিনটে বাড়ি। এর মধ্যে একটি বাড়ি নজর কেড়েছে সবার। স্থাপত্যের মূল বিষয় পরিবেশবান্ধব হওয়া। এই বৈশিষ্ট্য অর্জনের পাশাপাশি জীবনকে কোথাও যেন ছোট ছোট ক্ষণগুলোর মধ্য দিয়ে একটা উদ্যাপনের স্পষ্ট প্রচেষ্টা ডাউনির এই বাড়িটায় টের পাওয়া যায়।
শেল হাউস বা ডিমের অথবা বাদামের খোসার মতো বাড়ি মোটামুটি পরিচিত একটি ধারণা। কেননা এভাবে সীমিত ব্যয়ে, সীমিত সময়ের মাঝে নির্মাণ করা যায়। যেহেতু এই নির্মাণপদ্ধতিতে বহুতল ভবন বানানো যায় না, তাই এর সুখ্যাতি ততটাও ছড়ায়নি। বহুতল ভবন না হলে যে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবটা ধরে রাখা যায় না এই ব্যাপারটাকে ভেঙেছেন রবার্ট ডাউনি জুনিয়র। প্যাসিফিক সমুদ্রের পাশ দিয়ে থাকা ম্যালিবু শহরে অবকাশ যাপনের জন্য একটি বাড়ি প্রায় সব হলিউড সেলিব্রেটিদের রয়েছে। এখানেই অসমান্তরাল এক বাংলো বানিয়েছেন তিনি।
৭ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত ডাউনির এই বাড়িটি। বাড়িটিতে যেন সমুদ্র উপক‚লের বাতাস গায়ে আঁচড় কেটে যায়। পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যকে প্রাধান্য দিয়ে সরু ডিমের খোসার মতো এই বাড়িটি দেখামাত্রই মন ভালো হয়ে যাবে। যে স্থান আশ্রয় দেওয়ার মতো একটা পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম, সেখানে মানুষের ভালো লাগারই কথা। খোলা আকাশের নিচে দেখা যায় একটি গাড়ি আসার পথ, টেনিস কোর্ট, সুইমিংপুল, সফট-পেভ, হার্ড-পেভ, রোদ পোহানোর জায়গা, গাড়ি রাখার স্থান এবং সীমানার কিনার ঘেঁষে ঝোপের মতো গাছপালা ও কিছু কিছু লম্বাটে গাছ। অনুচ্চ বা একতলা ভবনগুলোর মাঝে একটা মায়া মিশিয়ে থাকে, যেহেতু তারা মাটির কাছাকাছি থাকেন। চাইলেই ছাদের নিচে একাকী আবার চাইলে বিরাট আকাশের নিচে একাকী হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মনের লুকোচুরি ছাপিয়ে বেরিয়ে আসা যায় সত্যের সামনে। এমনকি ঘরের ভেতরে থেকেও মাটিকে জানালা দিয়ে এত কাছ থেকে অনুভব করার মধ্য দিয়ে ন¤্রতা ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিমা বিশ্বে আকাশ দেখতে পাওয়াকে মানুষের অধিকার বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাই আশপাশে উঁচু ভবন না থাকায় শীতপ্রধান এই এলাকাগুলো গ্রীষ্মে সুন্দর রোদ পায়। ঘরের ভেতরও আলো-বাতাসে পরিপূর্ণ থাকে। এই ৭ একরের মাঝে কেবল ৬ হাজার ৫০০ বর্গফুট হলো নির্মিত ভবনের এলাকা। সাদাটে এই অতি সাদামাটা স্বাগত ভাব জানানো বাড়িটিকে তাই রবার্ট ডাউনি জুনিয়র নাম দিয়েছেন ক্লাবহাউস!
বীজের খোসার মতো দেখতে এই বাড়ির ধারণা উদ্ভূত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে দান্তে বিনির মাধ্যমে। ৯০ বছর বয়সী এই ইতালিয়ান ডিজাইনার যিনি মূলত শিল্প-বাণিজ্যের কাজ করে থাকেন। তিনি আবিষ্কার করেন যে নাইলনের বস্তার মাঝে বাতাস ভরে তার ওপরে স্টিলের রডের কাঠামো দিয়ে যদি বস্তার বাতাস বের করে দেওয়া হয়, তাহলে রডের কাঠামোটিও সেই আকৃতি বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এই ইতালিয়ান ডিজাইনের ছেলে নিকোলো, ডাউনির এই বাড়িটি ডিজাইন করেছেন। নিকোলো বাবার এই পদ্ধতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে স্থপতি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। বৈশ্বিক আবাসন সমস্যা মেটানোর লক্ষ্যে তিনি দ্রæত গতিসম্পন্ন ও সহজলভ্য ভবনের আন্দোলনে কাজ করছেন।
১৯৭০ সালে বিনি অস্ট্রেলিয়ায় এমন এক নাইলনের ফেব্রিকের নিচে টেনিস খেলতে গিয়ে এই বুদ্ধিটা পান। এরপর তিনি এই কাঠামোর প্রোটোটাইপ বানিয়ে নানা গবেষণা করে সেটাকে বর্ধিত করেন। বড় বড় জিমনেশিয়ামে এই কাঠামোর প্রয়োগ করেন এমনকি পাঠাগার ও শপিং সেন্টার যেখানে মাঝখানে ছাদকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো কলাম নেই এমন এমন জায়গায় এই পদ্ধতিতে ছাদ নির্মাণ করে দেখিয়ে দেন তিনি। এই স্থাপনাগুলো বহু ভূমিকম্প এড়িয়েও ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এখনো টিকে আছে।
ডাউনির সেরা চরিত্র আয়রনম্যান সিনেমার সিরিজের শেষ দিকের সময় অর্থাৎ, ২০১৩ সালে এই বাড়িটি নির্মাণের কাজে হাত দেন স্থপতি নিকোলো। তারা এমন এক বাংলো বাড়ির কথা ভেবেছিল, যেখানে বন্ধুদেও সঙ্গে নিয়ে আনন্দ করা যায় কিন্তু কোনো প্রকার আধিক্যের অনুভব যেখানে থাকবে না। ইতিমধ্যে এই বাড়িটিকে স্থাপত্যের একটা মাস্টারপিস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব ফিউচারিস্টিক এই বাড়িটিকে ঘিরে সবার আকর্ষণ চোখে পড়ার মতো। এই বাড়িসমেত পুরো সম্পত্তির মূল্য এখন ৩০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার।
দ্য হবিট-এ যেমন দরজা দেখা গিয়েছে এই বাড়িতেও তেমন দরজা দেখা যায়। ছাদের ফুটো দিয়ে আকাশের আলো সরাসরি ঘরের ভেতরে চলে আসে, জানালা কোনটাও প্রথাগত আকারের নয় এবং এই স্থাপনায় একটাও সমকোণ পাওয়া যাবে না। এমন আকৃতি আমরা কোনো বাড়িতেই বিশেষ দেখি না। তা ছাড়া চারপাশ দিয়ে সবুজ গাছ, বিশাল সুইমিংপুল, একটা উন্মুক্ত ছোট্ট চিড়িয়াখানা এই সাসটেইনেবল সাই-ফাই বা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে বর্ণিত বাড়ির মতোই।
স্থাপনার ভেতরের অংশগুলোতেও আছে অসাধারণত্বের ছোঁয়া। ম্যালিবু’র বিনি শেল হাউসটিকে এ জন্য পৃথিবীর অন্যতম একটি ম্যানসন হিসেবে ধরা হয়। এই জমিটা যখন ডাউনি ও তাঁর স্ত্রী সুজান কিনেছিলেন তখন এখানে দোতলা একটা বাড়িও ছিল। এই সাধারণ স্থাপনাকে না রেখে এখানে স্থপতি নিকোলো, যেভাবে একটা ফিউচারিস্টিক বাড়ির নিরীক্ষাগার বানিয়ে ফেললেন, তা অতুলনীয়। একটা রেট্রো, হিপি ভাব তার সঙ্গে আবার খুব ট্র্যাডিশনাল থাকা দুটোই কীভাবে যেন এখানে খুব সহজে মিশে গিয়েছে। কারণ ঘরের ভেতরে মনে হচ্ছিল, অনেক নেগেটিভ স্পেস থাকবে, যেহেতু সমকোণের নির্মাণ নেই। কিন্তু ভেতরের আবহতে সাধারণ জীবনযাপনকে উপেক্ষা করা হয়নি মোটেও। সেটা ইন্টেরিয়রের ছবিগুলো দেখলেই স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। ইন্টেরিয়রে বিশ্ববিখ্যাত আর্টিস্টদের পেইন্টিং এবং আর্ট পিস দিয়ে সাজানো হয়েছে, যা বাড়ির আকর্ষণ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। টেরাস, বেডরুম, বাচ্চাদের ঘর, গেস্টদের জন্য ঘর, স্টাডি, ডাইনিং, রান্নাঘর কী নেই এখানে। প্রতিটি ঘরের অভ্যন্তরীণ আকৃতি স্বাভাবিকভাবেই একে অন্যের থেকে ভিন্ন এবং তাই সজ্জা পদ্ধতি, আলো এবং ফার্নিচারের রং বাছাইয়ের বেলায়ও আছে ভিন্নতা ও সামঞ্জস্যতা। কোনো ঘরই প্রয়োজনের অতিরিক্ত বড় নয় বলে একটা আদুরে ভাব আছে, যেন কাছাকাছি থাকা যাচ্ছে এমন।
ঘরের আকৃতির পাশাপাশি ঘরের উচ্চতা বা মেঝের স্তর নিয়ে খেলা করেছেন স্থপতি ও ডাউনি। বাড়িটির অনেক ঘরকে বহুমাত্রিক কাজে ব্যবহারের সুযোগ করা আছে। এই জমিতে বড় গাছ বা ঝোপের মতো গাছগুলো বা গোটা ল্যান্ডস্কেপ যে ছবির মতো করে আঁকানো, তা দেখলেই বোঝা যায়। প্রতিটা জায়গাকে ধরে ধরে যতেœর সঙ্গে কাজ করা হয়েছে অথচ দেখলে প্রচেষ্টাহীন অর্গানিক একটা জায়গা বলে মনে হয়। আনা সাভেদ্রার এই মিনিমালিস্ট ডিজাইন মন ভরিয়ে দেয়। বাড়ির বাইরে ল্যান্ডস্কেপেও আর্টিস্টদের আর্টওয়ার্ককে ব্যবহার করা হয়েছে। ডাউনি ও তাঁর স্ত্রী সুজান দুজনেই কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর লক্ষ্যে কাজ করে এমন একটি ফাউন্ডেশনের কো-ফাউন্ডার, যারা সাসটেইনেবল প্রযুক্তি গড়ে তোলার জন্য জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে। এই কারণে এমন একটা বাড়ি আরও বেশি করে তাদের ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলে। রিনোভেট, রিডেকোরেট, নির্মাণ সব মিলিয়ে এতে ৭ বছর সময় লেগেছে।
এবার নির্মাণের গল্পটা বলা যাক। প্রথমে ঢ়হবঁসড়ভড়ৎস বা বায়ু চলাচলের মতো সিস্টেমটাকে যথাযথ জায়গায় জমিতে বসানো হয়। এরপর এর মাঝে বাতাস চালনা করে ফুলিয়ে তুলতে হয়, যা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কাঙ্ক্ষতি খোলসের আকার ধারণ করে। ভালোমতো বায়ুচাপ প্রয়োগ করে একে একটা স্থিতি প্রদান করানো হয়। এরপর এই আকৃতিকে ঘিরে রিবার স্থাপন করা হয়। যেহেতু এই রডকে সহজেই বায়ুসংবলিত বেলুন-জাতীয় কাঠামোর গা ঘেঁষে সঠিক আকার দেওয়া যায়, তাই ঘটনাটা খুব সহজেই সঠিক আকারকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সব জায়গায় রিবারকে যথাযথভাবে স্থাপনের পরে ক্রেনে করে তরল ংযড়পৎবঃব ছড়ানো হয়। শটক্রিট হলো স্প্রে করা যায়, এমন কংক্রিট। রেইনফোর্সমেন্টের জন্য এটা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সমস্ত স্থাপনায় এই গলিত কংক্রিট ছড়ানোর পর একে ভালোমতো শুকিয়ে নেওয়া হয়। এরপর ভেতরে থাকা বায়ুভর্তি ব্যাগটা থেকে বাতাসগুলো বের করে নেওয়া হয়। এটি মূলত ব্যবহারই করা হয়েছিল এই খোলসটা তৈরি করার জন্য। যেহেতু তার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেছে, ফলে এই পর্যায়ে এসে সেটিকে খুলে নেওয়া হলো। এরপর ভেতরে স্পেসটা দেখতে পাওয়া গেল। ধারণা পাওয়া গেল কেমন হচ্ছে বা হবে বাড়ির মূল কাঠামো। তখনো ভেতরে অনেক রাফ কংক্রিটের একটা অবস্থা আছে। বাহ্যিক দেয়ালগুলোও ততটা মসৃণ হয়নি তখনো। যখন এই কাঠামোকে একটা বসবাসের জন্য জায়গা হিসেবে ফিনিশিং দেওয়া হলো, তখন এটা একটা দারুণ বিষয় হয়ে উঠল।
নিঃসন্দেহে পরিবেশবান্ধব স্থাপত্য মানেই খুব কঠিন নির্মাণশৈলী হতে হবে বা অনেক খরচ করতে হবে এমন না। ইচ্ছে ও সৎবুদ্ধি থাকলে এমন অসংখ্য কাজ আমাদের দেশেও হওয়া খুবই সম্ভব। ডাউনির আয়রনম্যান চরিত্রটি আমাদের যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছে! প্রত্যাশা করা যায় তাঁর এমন সচেতন সিদ্ধান্তও সবাইকে উৎসাহ জোগাবে যেন স্থপতি ও প্রকৌশলীদের এমন প্রকল্প দিতে সাহস ও আস্থা রাখতে সমর্থ হই।
স্থপতি সুপ্রভা জুঁই
তথ্যসূত্র ও ছবি: ইন্টারনেট
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৮ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০২৩