মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অনেকটা সময় কেটে যায় তার অফিস বা কর্মক্ষেত্রে। সুন্দর একটি পরিবেশে কাজ করতে কার না ভালো লাগে? অথচ অফিস ইন্টেরিয়র ডিজাইনের ব্যাপারে আমরা খুব একটা সচেতন নই। একঘেয়ে পরিবেশে কাজ করতে করতে অনেক সময় মানুষ হারায় কাজের গতি। তাই উপযুক্ত কাজের পরিবেশ সৃষ্টি ও কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি সুন্দর ও নান্দনিক পরিবেশ জরুরি। এতে কাজের গতি বৃদ্ধি পায় এবং প্রতিষ্ঠানও পৌঁছাতে পারে কাক্স্ক্ষিত লক্ষ্যে। অন্দরসজ্জার পাশাপাশি অফিসের নান্দনিক সাজও কর্মীদের কর্মস্পৃহা বাড়ায়। আজ আমরা অফিস ইন্টেরিয়র ডিজাইনের ধারণা নিয়ে কথা বলব। ইন্টেরিয়র ডিজাইনার পয়েন্ট ওয়ান ইন্টেরিয়রসের সিইও মুহাম্মদ জহির উদ্দিন জানাচ্ছেন তাঁর অফিস ডিজাইনের কনসেপ্ট থিমগুলো সম্পর্কে, যেভাবে তিনি অফিসগুলোকে রূপায়িত করেন নজরকাড়া সৌন্দর্যে; কর্মিবান্ধব পরিবেশে। লিখেছেন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ফারজানা গাজী
অফিস ইন্টেরিয়র ডিজাইন করার সময় অনেক বিষয় বিবেচনা করতে হয়। এখানে রয়েছে অফিসের পটভ‚মির নকশা, দেয়ালের রঙের ধারণা, মেঝে পরিকল্পনা, সিলিং ডিজাইন, পুরো থিমের সঙ্গে মানানসই আসবাব, সবুজের ছোঁয়া, যা প্রকৃতিকে মনে করিয়ে দেয়, আলোকসজ্জার কারসাজি, সর্বোপরি অফিস স্থাপনার ইন্টেরিয়রের প্রতিটি বিষয় ধরেই এগোতে হয় একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনারকে।
ফ্লোর প্ল্যান আইডিয়া
আধুনিক অফিসগুলোতে আজকাল স্বল্প দেয়াল ও খোলামেলা একটা ভাব নিয়ে ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা হয়। দেয়াল কম হলে নির্মাণখরচও কমে। এতে অফিস পরিসরকে আরও বিস্তৃত দেখায় এবং লোকজন দ্রæত ঘোরাফেরা করতে পারে। ফ্লোর বা মেঝেতে কার্পেটের সংযোজন দেয় আভিজাত্যের ছোঁয়া। তা ছাড়া খালি মেঝেতে লোকজন হাঁটাচলা করার সময় যে শব্দের সৃষ্টি হয়, সেটার থেকে পরিত্রাণ দেয় এই কার্পেট।
সঠিক রঙের সামঞ্জ্যতা
অফিসের অভ্যন্তর নকশা ধারণায় রং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি অফিসের করপোরেট কালার থাকে। একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার অফিস ডিজাইন করার সময় সেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ব্র্যান্ডিং ফুটিয়ে তুলতে কোথাও কোথাও সেই রঙের প্রাধান্য দেওয়া হয় ক্ষেত্রবিশেষে। রঙের সঠিক ব্যবহার এবং সবকিছুর সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করে। মুহাম্মদ জহির উদ্দিনের মতে, কোন রং ব্যবহার করা হবে তা নির্ভর করে অফিসের পরিবেশ, আসবাবের সঙ্গে মিল এবং ক্লাইন্টের চাহিদা অনুযায়ী। অফিসের একটি নির্দিষ্ট স্থান করপোরেট রং ব্যবহার করলে স্থানটির প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ হবে। সাধারণত কমলা, লাল, নীল, সবুজ, অ্যাশ এই ধরনের রংগুলো এই ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অফিসের দেয়ালগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অফহোয়াইট, সাদা এই ধরনের রংগুলো ব্যবহার করা হয় উজ্জ্বল পরিবেশ ও আসবাবগুলোকে ফুটিয়ে তোলার জন্য। যেকোনো হালকা রং স্পেসকে বড় দেখাতে সাহায্য করে। রং মানুষের মনে বিস্তর প্রভাব ফেলে। তাই ঘরোয়া পরিবেশের সামান্য ছোঁয়া যোগ করা কর্মীদের শিথিল করতে, শীতল হতে এবং কাজের চাপ কম অনুভব করতে সহায়তা করবে। কম চাপের সঙ্গে কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি পায় ব্যাপকভাবে।
আসবাবের বৈচিত্র্য
ডেস্ক, টেবিল, চেয়ার, সোফা, ক্যাবিনেট একটি সম্পূর্ণ কার্যকর অফিসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুহাম্মদ জহির উদ্দিন তাঁর ডিজাইনকৃত অফিসগুলোর আসবাবের ডিজাইন করেছেন জ্যামিতিক ফর্মে। বিশেষ করে আয়তক্ষেত্র, বর্গক্ষেত্র, ট্রাপিজিয়াম, পেন্টাগন এই জ্যামিতিক আকারগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আসবাব তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে বার্মাটিক, সাদা পারটেক্স, মেলামাইন, গর্জন ইত্যাদি বোর্ড। আসবাবে রঙের ক্ষেত্রে হাত পলিশকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এতে কাঠের আসবাবের একটি আবহ তৈরি হয়। বিভিন্ন জায়গায় একটু ভিন্নতা আনতে রড আয়রনের স্কয়ার বার ব্যবহার করা হয়েছে, এর ব্যবহারে একটি রাষ্টিক লুক এসেছে আসবাবে, সঙ্গে নান্দনিকতার ছোঁয়া। আসবাবপত্র ডিজাইন করার সময় কম্পোজিশনকে অত্যন্ত সূ²ভাবে করা হয়েছে, যাতে বোর্ডের অপচয় রোধ করা যায়। একজন দক্ষ ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ক্লাইন্টের বাজেটকে মাথায় রেখে কাজ করেন বিধায় খুব দক্ষতার সঙ্গে এবং অনেক চিন্তাভাবনা করে ডিজাইনের কাজটি করে থাকেন, যা কি না একজন সাধারণ কিংবা অনভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
ফলস ছাদ ও আলোকসজ্জা
অফিসের ফলস ছাদ অফিস ডিজাইনের একটি অন্যতম পার্ট। অফিসের উচ্চতা সাধারণত ফ্লোর থেকে ছাদ পর্যন্ত আট ফুটের বেশি রাখা হয় না। জিপসাম সিলিংয়ের পাশাপাশি বোর্ডের সিলিংয়ে ব্যবহার দেয়ালে আলোর ব্যবস্থা থাকলেও অফিসের ক্ষেত্রে বেশির ভাগই সিলিংকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। অফিসে ডিরেক্ট ও ইনডিরেক্ট আলো বেশি ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে পেনডেন্ট, ডিফিউস, হিডেন ও ইনডিরেক্ট ওয়ার্ম লাইকে প্রধান্য দেন ডিজাইনার। একটু ভিন্নতা আনতে বোর্ডের সিলিংয়ের সঙ্গে ব্যবহার করেন রড আয়রণ, যা কি না আসবাবের সঙ্গে সামঞ্জ্যপূর্ণ।
প্রাকৃতিক উপাদান
অভ্যন্তরীণ ডিজাইনে প্রাকৃতিক উপাদানের অন্তর্ভুক্তি অফিসটিকে আরও প্রাণবন্ত ও কাস্টমাইজড মনে হয়। এই ধারণাটি বায়োফিলিক নকশা অন্তর্ভুক্ত করা হিসেবে পরিচিত। এটি কর্মীদের প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। অফিস ব্যাকগ্রাউন্ড ডিজাইনে বায়োফিলিক ডিজাইন অন্তর্ভুক্ত করার একটি জনপ্রিয় উপায় হলো গাছপালা দিয়ে সাজানো। গাছপালা জায়গাটিতে একটি প্রাকৃতিক উদ্দীপনা যোগ করে আকর্ষণীয় করে তোলে। গাছপালা বায়ু শুদ্ধ করে এবং মনকে প্রফুল্ল করে চাপ কমাতে সাহায্য করে। গাছপালা ব্যবহার করার সময় দেয়ালে কাঠের প্যানেল যুক্ত করা হয় ভিন্ন আমেজ দিতে। প্রাকৃতিক আমেজ দিয়ে কিছু জায়গায় ও জানালায় ব্যবহার করা হয় বাঁশের চিক। প্রাকৃতিক উপাদানের যথাযথ স্পর্শ যোগ করে স্থানটিকে শান্ত ও ঘরোয়া পরিবেশের ছোঁয়া দেওয়া হয়।
বিভিন্ন অফিসে আজকাল জিম, ইনডোর গেম ও নানা ধরনের রিফ্রেশমেন্টের ব্যবস্থা রয়েছে। একটি সুন্দর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ কাজের স্ট্রেস কমানোর সঙ্গে সঙ্গে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে। সুন্দর পরিবেশ কর্মীদের মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। গোছানো পরিবেশে গুছিয়ে কাজ করাটা অনেকটা সহজ হয়। অফিস ইন্টেরিয়র ডিজাইন করার আগে কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। সেগুলো হচ্ছে-
অফিস ইন্টেরিয়র ডিজাইন করার সময় বাজেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কমফোর্ট এবং ফাংশনের বিষয়কে প্রাধান্য দিতে এ বিষয়টি ভাবা জরুরি
রিসিপশন ডেক্স অথবা টেবিল ডিজাইনে করার সময় কী ধরনের অফিস, সেই বিষয়টি মাথায় রেখে ডিজাইন করতে হবে। কারণ এটি অফিসের প্রথম দর্শন, যেটার ওপর কাস্টমার এবং অফিসের কর্মীদের মধ্যে সংযোগ তৈরি করে
আজকাল মডার্ন এবং ওপেন অফিসের কনসেপ্ট খুব প্রশংসনীয়। কারণ অতিরিক্ত রুম কিংবা বদ্ধ ওয়ার্কস্টেশন কর্মীদের মধ্যে বাধা হিসেবে কাজ করে। ওপেন স্পেস অফিসকে বড় দেখাতে সাহায্য করে
অফিস ইন্টেরিয়র ডিজাইনের ক্ষেত্রে লাইটিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। আলোর বিষয়টি খুব কম বা খুব বেশি হওয়া কর্মক্ষেত্রের ব্যাঘাত ঘটায়। তাই সচেতনভাবে লাইটিং বা আলোর ব্যবহার করতে হবে
করপোরেট রঙের সঙ্গে মিল রেখে কার্পেটের রং নির্বাচন করা যেতে পারে। সাধারণত বেশির ভাগ অফিসে নীল, লাল, সবুজ, অ্যাশ এই ধরনের কার্পেটের রং নির্বাচন করা হয়ে থাকে।
যেকোনো অফিসের ব্র্যান্ডিংটা খুব জরুরি। তাই রিসিপশন এবং কনফারেন্স রুমের যেকোনো একটি দেয়াল ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য বেছে নিতে পারেন।
যেহেতু অফিসে দীর্ঘ সময় বসে কাজ করতে হয়, যা স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত, তাই অফিসের চেয়ার অথবা আসবাবগুলো আরামদায়ক হওয়া জরুরি।
লেখক:
স্বত্বাধিকারী/সিইও
ফারজানা’স বিøস্
ভধৎুধহধমধুর@ুধযড়ড়.পড়স
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৪৯ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৩