অগ্নিকাÐ নাগরিক জীবনে অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। গ্রামে কিংবা শহরে যে কোন জায়গায় ঘটতে পারে অগ্নিকাÐের মতো অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা। তবে গ্রামের চেয়ে শহরের অগ্নিকাÐ হয় ভয়াবহ। খোলামেলা জায়গার অভাব, জল ও জালাধারের সঙ্কট, উষ্ণ বাতাস, অসাবধানতা ইত্যাদি নানা করণে ঘটে শহরের অগ্নিকাÐ। অপরদিকে গ্রামে অগ্নিকাÐ ঘটলেও তা খুব দ্রæত নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। তাই শহরের ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই উচিত বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন। শহরে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠা অপরিকল্পিত ভবনগুলোতে যথাযথ অগ্নি প্রতিরোধ বা অগ্নি নির্বাপানের ব্যবস্থা না থাকায় দিন দিন অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। ফলে জীবনেরও ঝুঁকি বাড়ছে নাগরিকদের। নাগরিকদের জীবনে এমন দুর্ঘটনা কোনভাবেই কাম্য নয়। তাই ভবন নির্মাণের আগে দরকার অগ্নি নিরাপত্তা, যার সাত-সতোরো জানাচ্ছেন সারোয়ার আলম
অগ্নি নিরাপত্তা দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অগ্নিকাÐজনিত দুর্ঘটনা মানুষকে জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে শেখায়। অগ্নি দুর্ঘটনা যে কোন জায়গায় এবং যে কোন সময় ঘটতে পারে। তাই কিভাবে জরুরি অবস্থায় নিজেকে এবং নিজের সম্পত্তি রক্ষা করতে হবে সে বিষয়ে আমাদের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি থাকা অত্যন্ত জরুরি। আগে ভবন নির্মাণে অগ্নি নিরাপত্তার ব্যবস্থা সংযোজন করতে কাঠামোগত নকশা তৈরি করা সহজ ছিলো না। আধুনিক সময়ে ক্রমবর্ধমান সচেতনতার কারণে প্রকৌশলী এবং স্থপতিরা ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি এবং নকশা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
অগ্নি দুর্ঘটনা ও বাংলাদেশ সমীকরণ
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও ইÐাস্ট্রিয়াল ভবনগুলোতে যে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয় তা কেবলই নামমাত্র। ভবনগুলোতে অগ্নি নির্বাপনের প্রায় সমস্ত ব্যবস্থাই আছে, তবুও আগুন লাগলে অগ্নি নির্বাপণ সরঞ্জামগুলো বিশেষ কাজে আসে না। স্মোক ডিটেক্টর, ফায়ার ডিটেক্টর, কার্বন-ডাই-অক্সাইড সিলিন্ডার, বালুভর্তি বালতি, হোসপাইপ কোন কিছুরই কমতি থাকে না। তবুও আগুন লাগলে যেন থামতেই চায় না। ফায়ার সার্ভিসের একাধিক ইউনিটের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যতক্ষণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে ততক্ষণে জানমালের যা ক্ষতি হওয়ার তাই হয়।
উন্নত বিশ্বে অগ্নিকাÐের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঋরৎব ঝঢ়ৎরহশষবৎ ঝুংঃবস (ঋঝঝ) নামের একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এতে থাকে দুটি ইউনিট। একটি কন্ট্রোল ইউনিট এবং অপরটি ডিস্টিবিউশন ইউনিট। এই সিস্টেমটি অন্য সাধারণ সিস্টেমের চেয়ে ব্যয়বহুল হওয়ায় বাংলাদেশে সামান্যইা ব্যবহার করা হয়। সিস্টেমটি একেবারেই স্বয়ংক্রিয় হওযায় দাম তুলনামূলক বেশি, তবে নিরাপত্তাও সর্বাধিক।
বাংলাদেশের কমার্শিয়াল স্পেস কিংবা কারখানায় যে অগ্নিনির্বাপন সরঞ্জাম চোখে পড়ে তা ফ্লোরের জায়গা ও মানুষের সংখ্যার অনুপাতে খুবই সামান্য। এগুলো বছরের পর বছরও হালনাগাদ করা হয় না। তাই মেয়াদউত্তীর্ণ এসব সরঞ্জাম ও উপকরণগুলো কোন কাজেই লাগার মতো নয়। জরুরি বহির্গমন সিড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা। কোন ভবনে অগ্নিকাÐের সময় জরুরি বহিগর্মন সিড়ি না থাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ বেড়ে যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জায়গা বাঁচাতে বেশিরভাগ ভবনেই এ ধরণের কোন ব্যবস্থা রাখেন না ভবন মালিকরা। এছাড়াও অপরিকল্পিত ভবন ডিজাইনের কারণেও জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি থাকে না। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সিড়ি থাকলেও অব্যস্থাপনা ও পরিকল্পনা না থাকায় অগ্নিকাÐের ঘটনা ঘটলে সেগুলো ব্যবহার করা যায় না। তবে দেশের গার্মেন্স সেক্টরে বেশ কিছু অগ্নিকাÐ সংগঠিত হওয়ার পর, ভবনগুলোতে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিকাÐের ঘটনা সবচেয়ে বেশি হয়। অপরিকল্পিত ইলেকট্রিক ডিজাইন, নি¤œমানের বৈদ্যুতিক উপকরণ ব্যবহারসহ নানা করণে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশের ৭০ ভাগ অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে। গত এক দশকে বাংলাদেশ শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র এসির ব্যবহার বেড়েছে কয়েক গুণ। আরামদায়ক গেজেটটি ব্যবহারে প্রয়োজন হয় অনেক বেশি বৈদ্যুতিক লোড। তাই পর্যাপ্ত লোড না থাকলে কিংবা ব্যবহৃত কেবলের কার্যক্ষতা লোডের তুলনায় কম হলেও অনেক ক্ষেত্রে শর্ট সার্কিট হয়ে থাকে। তাই ভবন নির্মাণের আগে ইলেকট্রিক ডিজাইন করার সময় এবং ওয়্যারিং করার সময় বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব না দেয়া হলে ঝুঁকি সবসময় পিছু তাড়া করবেই।
আধুনিক দৃষ্টিনন্দন ভবনগুলো বেশিরভাগই কাঁচ দিয়ে ঘেরা। এর ফলে অগ্নিকাÐের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাছাড়া কাঁচের জানালা কিংবা কাঁচের দেয়াল যা রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তা একেবারেই পরিবেশবান্ধব নয়। এমন ভবনগুলোতে ফায়ার সার্ভিস কোথায় বহিগর্মনের জন্য ল্যাডার যুক্ত করবে তার কোন নির্দেশনা থাকে না। নির্দেশনা থাকে না কাঁচ ভাঙ্গারও। তাছাড়া কাঁচ ভাঙ্গতে যেসব সরঞ্জাম প্রয়োজন, সেগুলোও রাখা হয় না।
বাংলাদেশে অগ্নিকাÐের প্রধান কারণ
অগ্নিকাÐ নানা কারণে ঘটে থাকে। এককভাবে কোন কারণকে সুনির্দিষ্ট করে দায়ি করা সম্ভব নয়। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দায়ি করা হয় বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটকে। এর পেছনে অনেক যুক্তি, গবেষণা এবং অভিযোগও রয়েছে। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট ছাড়াও আরও অনেক কারণেই অগ্নিকাÐ ঘটে থাকে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
রান্নাঘরের চুলা ও গ্যাস সিলিন্ডার থেকে দুর্ঘটনা
ধূমপান
মোমবাতি
হিটার
বারবিকিউ
স্পেস হিটার এবং
দাহ্য পদার্থের যথাযথ সংরক্ষণের অভাব।
এই কারণগুলোর মধ্যে প্রায়ই তাপ, জ্বালানি এবং অক্সিজেনের সংমিশ্রণ একত্রিত হলেই দুর্ঘটনার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। রান্নার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটে যখন গরম পৃষ্ঠ বা খোলা অগ্নিশিখা তেলের মতো দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আসে তখন। বৈদ্যুতিক ত্রæটির কারণে স্ফুলিঙ্গ হতে পারে যা কাছাকাছি দাহ্য পদার্থকে জ্বালায়। ধূমপান, মোমবাতি এবং বারবিকিউ সবই উত্তপ্ত স্পার্ক বা অঙ্গার নির্গত করতে পারে যা আশেপাশের উপকরণগুলোকে জ্বালাতে পারে। স্পেস হিটার এবং স্টোভগুলো দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে এলে অত্যধিক গরম হয়ে আগুন লাগতে পারে।
অগ্নি প্রতিরোধে করণীয়
অগ্নি নির্বাপন
আগুন প্রতিরোধ বা অগ্নি নির্বাপনের কথা মাথায় আসতেই প্রথমে ভাবতে হবে অগ্নিকাÐের কারণ সম্পর্কে। অগ্নি প্রতিরোধে প্রথমেই উপরের কারণগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আগুন লাগলে প্রথমেই উচিত পুরো ভবনটি খালি করে দেয়া। সে কারণে অবশ্যই পূর্ব পরিকল্পনা থাকতে হবে। জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি এক্ষেত্রে একমাত্র বিকল্প। আগুন যদি ছোট হয় বা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে তবে অবশ্যই তা নেভানোর জন্য চেষ্টা করতে হবে। তবে যদি আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় সেক্ষেত্রে অবশ্যই দমকল বাহিনীকে জানাতে হবে।
ধোঁয়া বেশি হলে অবশ্যই উঁচু হয়ে থাকা যাবে না। অর্থাৎ ফ্লোরে নিচু হয়ে থাকতে হবে। ধোঁয়ার সাথে বাড়তে পারে বিষাক্ত গ্যাসও যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই স্মোক ডিটেক্টর ব্যবহার করা একান্ত আবশ্যক। এর ফলে অগ্নিকাÐের শুরতেই এলার্ম বেজে উঠবে। আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই ভবনে থাকা মানুষরা বাইরে যাওয়ার সুযোগ পাবে।
এছাড়াও ভবন নির্মানের পূর্বে অগ্নি প্রতিরোধের পরিকল্পনা করে নিলে অগ্নি প্রতিরোধ খুব সহজ হয়। ভবনের নকশা তথা পরিকল্পনায় অগ্নি নির্বাপনের বিষয়টি যুক্ত করলে তার ধরণও অবশ্য অন্যান্য সাধারণ ভবনের চেয়ে আলাদা হবে। আলাদা হবে ডিজাইন বা নকশার ক্ষেত্রে, উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে স্থপতি ও প্রকৌশলীদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়।
অগ্নি প্রতিরোধী দেয়াল
অগ্নি প্রতিরোধী দেয়াল বলতে আসলে বিশেষ কোন দেয়ালের কথা বলছি না। সাধারণ একটি দেয়াল ভবনে যা থাকে সেটিকেই একটু বিশেষভাবে চিন্তা করলে তা হতে পারে ফায়ারওয়াল। লোড বহনকারী দেয়াল আগুনের বিস্তারকে কমাতে সাহায্য করে। সেকারণে শুধু অগ্নিকাÐর ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকেই বাঁচা যায় না একইসাথে ভবনের স্থায়িত্বও বাড়ে। এই দেয়ালগুলো, যা কাঠামোর ওজনকে বহন করে তা আগুনের বাধা হিসেবেও কাজ করে। শিখা এবং ধোঁয়ার বিস্তারকে সীমিত করে। এগুলোকে কংক্রিট দিয়েও বিশেষভাবে তৈরি করা যেতে পারে আবার সাধারণ কংক্রিটের দেয়ালে অগ্নি-প্রতিরোধী উপকরণ দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে। ভবন নির্মাণের আগে ভার বহনকারী (বীমের নিচের দেয়াল, পার্টিশন ওয়াল) দেয়ালগুলো অগ্নি প্রতিরোধী করা যেতে পারে। ফলে ভবনের এক ইউনিটে আগুনের সুত্রপাত হলেও অন্য ইউনিটে সহজেই তা ছড়িয়ে পাড়বে না।
কাঠামোগত ফ্রেমিং
ভবনের অবকাঠামো তৈরির জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয় রড, সিমেন্টের পিলার ও বীম। এছাড়াও বর্তমানে কাঠ ও ইস্পাতের ব্যবহার বাড়ছে। ফ্রেমযুক্ত কাঠামো দুই ধরণের হতে পারে, কংক্রিট এবং ইস্পাত কাঠামো। ইস্পাত কাঠামো সাধারণত ভারী আগুনের মধ্যে মোচড়ে যেতে পারে কিংবা বিকৃত হয়ে যেতে পারে। তাই ইস্পাত কাঠামোর ক্ষেত্রে ধাতব ল্যাথ বা প্লাস্টারের একটি প্রতিরক্ষামূলক আবরণ দেওয়া হয়। ইট, কংক্রিট বা টাইলসও ব্যবহার করা যেতে পারে তবে সেক্ষেত্রে তাদের সর্বনি¤œ বেধ ১০ সে.মি হওয়া উচিত।
রিইনফোর্সড কংক্রিটের ক্ষেত্রে, ফ্রেমের সাথে যুক্ত বিম এবং কলামে অগ্নিকাÐের সময় তাদের সর্বোচ্চ কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত কংক্রিটের আবরণ থাকা উচিত। এই কভারটি কমপক্ষে ৫ সেন্টিমিটার পুরু হলে ভালো হয়।
জীবন যেন ভালো থাকে, নিরাপদ থাকে তা নিশ্চিত করতে মানুষ প্রতিমুহূর্তেই সংগ্রাম করে চলেছে। আসলেই আমরা নিরাপদ আছি? কতটা নিরাপদ আছি তা নিয়ে কারো যেন কোন মাখাব্যথা নাই। তাই নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেদেরই পালন করতে হবে সবার আগে। রান্নার ফাঁকে অকারণে চুলো জালিয়ে রাখা, ধুমপান শেষে যত্রতত্র ছুঁড়ে ফেলা, দাহ্য পদার্থ যত্রতত্র রাখার মতো বিপজ্জনক কাজগুলো আমাদের খুব সাবধানে সম্পন্ন করতে হবে। আমরা যেমন প্রত্যাশা করি সরকার এবং ভবন মালিকরা তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে, একইভাবে নাগরিক হিসেবেও আমাদের দায়িত্ব পালন অগ্নিকাÐের সম্ভাবনা কমাতে পারে অনেকাংশেই।
ংনহংধৎধিৎ@মসধরষ.পড়স
তথ্যসূত্র
দৈনিক ইত্তেফাক, ংড়সবযিবৎবরহনষড়ম
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫১ তম সংখ্যা, মার্চ ২০২৩