ঘর সাজাতে মাটির অলংকার

একসময় ঘর বা অন্য কোনো স্থাপনার দেয়ালে পোড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটা ব্যবহার হতো যেন অমসৃণ দেয়ালটাকে বাইরে থেকে দেখতে খারাপ না লাগে। আর মাটির তৈরি পাত্র তো অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল প্রতিটি বাঙালি ঘরে। ঘরের সৌন্দর্যবর্ধনে আর ঘর সাজানোর হাজার রকম উপকরণ সহজলভ্য হলেও এখনো কমেনি টেরাকোটা বা মাটির তৈজসের কদর। এখন শুধু দেয়াল ঢাকতে নয়, ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে ব্যবহৃত হচ্ছে পোড়ামাটির ফলক। আর ঘর সাজানোর জন্য ব্যবহার হচ্ছে মাটির তৈরি বিভিন্ন রকম জিনিস যেমন, বসার ঘরের টেবিলে রাখা ফুলদানি, দেয়ালে টাঙানো মাটির মুখোশ, কিংবা শোকেসের ভেতর মাটির তৈরি বিভিন্ন রকম পাত্র বা শোপিস।

আমাদের দেশে পোড়ামাটির ব্যবহার বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। ঘর তৈরি থেকে শুরু করে ঘর সাজানো, ঘরের নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজস, গয়না প্রায় সবখানেই পোড়ামাটির ব্যবহার হয়। এশিয়া মহাদেশে পোড়ামাটির ব্যবহার শুরু হয় আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতার শুরুতে। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতায় ব্যবহৃত পোড়ামাটির হাঁড়ি-পাতিল, তাবিজ, গয়না ইত্যাদির নিদর্শন প্রমাণ করে এ অঞ্চলে মাটির শৈল্পিক ব্যবহারের ঐতিহ্য।

নদীবিধৌত কাদামাটির এ দেশের আদি শিল্পীরা তাঁদের শিল্প চর্চার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন সহজলভ্য কাদামাটির। তাঁরা তাঁদের শিল্পকর্মকে সুনিপুণ হাতে ফুটিয়ে তোলেন বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে অথবা মাটির ব্লকে, যা সারা পৃথিবীতে টেরাকোটা নামে পরিচিত।

হরেক রকম মাটির তৈজসপত্র ও মাটির শোপিস

বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পোড়ামাটির তৈরি জিনিসের ব্যবহার হচ্ছে মূলত ঘর সাজানোর কাজে। মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, টব, ফ্লাওয়ার ভাস, কলমদানি, মোমদানি, মশা তাড়ানোর কয়েল জ্বালানোর পাত্র, থালা, মগ, বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর প্রতিকৃতি, গয়না, পোড়ামটির ফলকে অঙ্কিত চিত্র বা টেরাকোটা যেমন দেশের রুচিশীল ব্যক্তিরা ব্যবহার করছেন ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে, তেমনি বিদেশিরাও বেশ আগ্রহী হয়ে উঠছেন এসব উপকরণের প্রতি।

বাংলার পোড়ামাটির শিল্প বা মৃৎশিল্প কয়েকটি ধারায় বিদ্যমান। একটি ধারা, যেখানে শিল্পীরা সংসারের নিত্যব্যবহৃত তৈজসপত্র যেমন হাঁড়ি-পাতিল, ঢাকনা, কলস, সানকি ইত্যাদি তৈরি করে। আরেকটি ধারার শিল্পীরা গয়না, শোপিস, ডেকোরেটিভ পট ইত্যাদি তৈরি করে। অন্য আরেকটি ধারা হচ্ছে টেরাকোটা, যেখানে শিল্পী তাঁর মনের মাধুরী মিশিয়ে মাটির বুকে চিত্রিত করেন গ্রাম বাংলার বিভিন্ন গল্প, ঐতিহাসিক কাহিনি, চরিত্র ইত্যাদি। এই টেরাকোটা একসময় মসজিদ, মন্দির, প্রাসাদ বা ভবনের সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার হতো। যেমন, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি, দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত মন্দির ও মঠে এ শিল্পের বহু নিদর্শন রয়েছে। এসব স্থানে যে শিল্পনিদর্শনগুলো দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে রাধাকৃষ্ণ, শিব-দুর্গা, কালী-সরস্বতী, নারীমূর্তি, বলরাম, বৌদ্ধজাতক, রাম, গাড়ি, রামায়ণ-মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনির দৃশ্যাবলি, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কাহিনি, রাম-রাবণের কাহিনি, বিবাহের দৃশ্যাবলি, বিভিন্ন ফুল-ফল-পাতা, পালকি আর পশুপাখির মূর্তিসহ অনেক কিছু।

এ ছাড়া বিভিন্ন মুসলিম স্থাপনা যেমন, গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদ, বিবিচিনি শাহি মসজিদ, বাবা আদম মসজিদ, বাঘা মসজিদ, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, রাজশাহীর বিড়ালদহ মাজারসহ আরও অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনায় টেরাকোটার শিল্পকর্ম দেখা যায়। টেরাকোটার এসব অলংকরণ আসলে আমাদের শৈল্পিক মানসিকতারই পরিচয় বহন করে।

টেরাকোটা শিল্পকর্ম ও ঘর সাজাতে মাটির পটারি

আমাদের দেশের মৃৎশিল্পের শিল্পীরা প্রায় সবাই পাল সম্পদায়ের। স্থানীয়ভাবে এরা কুমার বা কুম্ভকার নামে পরিচিত। ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে এরা হিন্দু। তবে অনেক মুসলমান শিল্পীও এ পেশায় রয়েছেন।

মৃৎশিল্পের প্রধান উপকরণ হচ্ছে মাটি। এটি একটি শ্রম ও সময়নির্ভর শিল্প। সাধারণত এঁটেল মাটিকে অনেক সময় নিয়ে মসৃণ করে ছেনে তারপর খালি হাতে বা চাকে মাটি বসিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা হয়। এরপর কয়েক দিন রোদে শুকিয়ে উচ্চ তাপে এগুলোকে চুল্লিতে (স্থানীয়ভাবে ভাটি বা পইন নামে পরিচিত) আগুনে পোড়ানো হয়। তারপর এক বা দুই দিন সময় নিয়ে ঠান্ডা করা হয়। এরপর তা ব্যবহারের উপযোগী হয়ে ওঠে। মৃৎশিল্পে লাল ও কালো রং পোড়ানোর আগেই দেওয়া হয় কিন্তু সাদা, নীল, সবুজ ইত্যাদি রং পোড়ানোর পর টেকসই করে রং দিয়ে দৃষ্টিনন্দন করা হয়।

গ্রামবাংলার অধিকাংশ কুমাররা সংসারে ব্যবহৃত জিনিস যেমন, হাঁড়ি-পাতিল, থালা, পানির কলস, ঘড়া গাড়ু, ঘটি, মালসা, সানকি, ঢাকনা, ঝাঁজর, চালুনি, পানি খাওয়ার পাত্র, সুরাই, ভাঁড়, মাটির ব্যাংক, বদনা, পেয়ালা, দইয়ের পাতিল, কড়াই, মটকী, প্রদীপ ইত্যাদি তৈরি করেন। আর ঈদ, পূজা বা মেলা উপলক্ষে শখের হাঁড়ি, টেপা পুতুল, বিভিন্ন ধরনের গয়না, মাছ ধরার জালের কাঠি, জলকান্দা, পিঠা তৈরির ছাঁচ, বাচ্চাদের জন্য খেলনা হাঁড়ি-পাতিল, কলস, ঢাকনাসহ হাতি, ঘোড়া, কুমিরের মতো বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি তৈরি করেন।

সারা দেশে কুমাররা ছড়িয়ে থাকলেও শিল্প মানে উত্তীর্ণ পণ্য তৈরিকারক কুমার দেশের অল্প কয়েকটি জায়গায় রয়েছেন। যেমন, ঢাকা শহরের রায়েরবাজার, সাভার, কালিয়াকৈর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, রাজশাহী, শরীয়তপুর, কুমিল্লা প্রভৃতি। এসব এলাকার শিল্পীদের তৈরি সামগ্রীর দেশে যেমন কদর রয়েছে, তেমনি বিদেশেও বেশ সমাদৃত। এঁদের তৈরি টেরাকোটা, ভাস্কর্য, জীবজন্তু, পাখির অবয়ব, সাজসজ্জা অলংকার, ফুলদানি, মোমদানি, কলম, কলমদানি, টেবিল ল্যাম্প, ফটোফ্রেম, অ্যাশট্রে, ঘণ্টা, কাপ, ওয়াল শোপিস ও বিভিন্ন ধরনের মুখোশ ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে আড়ং, কারিকা, ইনফ্যাক্টস-ডু-ম্যান, ব্র্যাক, হ্যান্ডিক্রাফটস, কুমুদিনী, আইডিয়াসসহ ঢাকা শহরের অনেক নামীদামি প্রতিষ্ঠানে। এ ছাড়া রাজধানী রায়েরবাজার, শাহবাগ, শিশু একাডেমির সামনে, মিরপুর ২ নম্বর স্টেডিয়ামসংলগ্ন থেকে মিরপুর ১ নম্বরের রাস্তার পাশসহ পুরান ঢাকা, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি, মিরপুর রোড, ফার্মগেটসহ অনেক জায়গাতেই এসব পণ্য বিক্রি হয়।

মাটির নান্দনিক ফুলের টব ও মাটির পটারি

বাড়ির প্রধান ফটক থেকে শুরু করে শোয়ার ঘর সবখানেই নান্দনিক রূপ দিতে ব্যবহার করা যেতে পারে পোড়ামাটির চিত্র। বসার ঘরের দরজায় পোড়ামাটির কোনো প্রতিকৃতি; টেবিলের ওপর ফুলদানিটা যদি হয় মাটির তৈরি কারুকার্য খচিত আর পেছনের বড় দেয়ালটায় টেরাকোটার বড় একটা নকশা। দেখুন না সাজিয়ে কেমন লাগে দেখতে? তবে যত্ন আর পরিচর্যার কথাটা মাথায় রাখবেন কিন্তু!

আবু সুফিয়ান

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৫ তম সংখ্যা, জুলাই ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top